বেলাব (নরসিংদী) প্রতিনিধিঃ
বেলাবতে শিক্ষকদের দায়সারা পাঠদান,কিছু বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও পরিচালনা কমিটির সভাপতির সাথে দ্বন্ধের কারনে চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি ফল বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত মোবাইল আসক্তি ও মাদকাসক্ত হওয়ার কারনেও ফল বিপর্যয় হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে।
উপজেলার বিভিন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে চলতি বছর সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে বেলাবতে মানবিক বিভাগে। আর যেসব শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছেলে শিক্ষার্থী। ছেলে শিক্ষার্থীরাই বেশি মোবাইল আসক্ত ও মাদকাসক্ত। তবে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অভিযোগ শিক্ষকদের পাঠদানে মারাত্মক ভাবে অনিহা,ম্যানেজিং কমিটির সাথে দ্বন্ধে জড়িয়ে পড়াসহ বিভিন্ন কারনে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় ফল বিপর্যয় হয়েছে।
এরই মধ্যে ফল বিপর্যয়ের কারনে উপজেলার সল্লাবাদ ইউনিয়নের সররাবাদ ধনু মাষ্টার উচ্চ বিদ্যালয়ে তালা ঝুলিয়েছে উত্তেজিত এলাকাবাসি। এসময় এলাকাবাসি প্রধান শিক্ষক আবু হানিফসহ বিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষকদের অবরোদ্ধ করে রাখে কিছু সময়। পরে তারা প্রধান শিক্ষক আবু হানিফকে ফল বিপর্যয়ের জন্য দোষারুপ করে বিদ্যালয় থেকে চলে যাবার নির্দেশ দেন। এসময় সররাবাদ এলাকার কয়েকশ বিক্ষুব্ধ মানুষ বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে ছুটে আসলে সুযোগ বুঝে প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয় থেকে চলে যায়। প্রধান শিক্ষক চলে যাবার পর আস্তে আস্তে বাকি শিক্ষকরাও বিদ্যালয় থেকে চলে যায়। ঘটনাটি গতকাল রবিবার সকাল সাড়ে ১০টায়।
জানা যায়,সররাবাদ ধনু মাষ্টার উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ১১২ জন পরীক্ষার্থী। এর মধ্যে ৭৫ জন পরীক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়। যার মধ্যে শুধু মানবিক বিভাগেরই রয়েছে ৭৩ জন। এমন হতাশা জনক ফলাফলে এলাকাবাসি প্রধান শিক্ষক আবু হানিফকে দোষারুপ করে। এলাকাবাসি অভিযোগ করে বলেন,আবু হানিফ দীর্ঘ দুই যুগের মত বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ দীর্ঘসময়ে তিনি বিদ্যালয়ে সৃষ্টি করেন একক আধিপত্য। তার এই আধিপত্যের প্রভাব পড়ে পাঠদানে। যার কারনে এত বেশি শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে।
অন্যদিকে বিন্নাবাইদ ইউনিয়নের কাশিমনগর উচ্চ বিদ্যালয়ে এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি ফল বিপর্যয় হয়েছে। জানা গেছে এ বিদ্যালয়ে চলতি বছর ২০৪ জন পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হয় ৮৪ জন। এর মধ্যে ৬৫ জন শিক্ষার্থীই মানবিক বিভাগের। এ বিদ্যালয়টিতেও দীর্ঘদিন ধরে প্রধান শিক্ষক ও পরিচালনা কমিটির সভাপতির সাথে দ্বন্ধ ছিল। আর এ দ্বন্ধের অজুহাতে বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ ছুটি ছাড়াই প্রায় দেড় বছর বিদ্যালয়ে ছিলেন অনুপস্থিত।
আর এই অনুপস্থিত কারনে অন্যান্য শিক্ষকরাও স্কুল চালিয়েছেন নিজেদের ইচ্ছেমত। প্রতিদিন দুপুরেই শিক্ষার্থীদের ছুটি দিয়ে স্কুলে তালা লাগিয়ে বাড়িতে চলে যেতেন বিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষকরা। এসব কারনে পাঠদান হয়নি নিয়মিত। যার প্রভাব পড়ে এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে।
শুধু এই দুই বিদ্যালয়েই নই। বেলাব উপজেলার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ড়–লোর মধ্যে ২৯টি বিদ্যালয়ের অনলাইনে প্রকাশিত এসএসসি ফলাফলে দেখা গেছে। এসকল বিদ্যালয়ে দুই হাজার সাতশত তেইস জন পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে ৬০৯ জন পরীক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়। যার মধ্যে শুধু মানবিক বিভাগেই অকৃতকার্য হয় ৫২৯ জন।
মানবিক বিভাগে এত বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হবার কারন অনুসন্ধানে সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে কথা হয় শিক্ষার্থী ,অভিভাবক .শিক্ষক ও সুশিল সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অভিযোগ শিক্ষকদের দায়সারা পাঠদান,শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির দ্বন্ধ,ক্লাসে কম পড়িয়ে কোচিং এ বেশি পড়ানোর প্রবণতাসহ প্রভৃতি কারনে এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় এত বেশি শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষকদের অভিযোগ শিক্ষার্থীরা অতিরিক্ত মোবাইল আসক্তি,ছেলে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত,পড়ার টেবিলে না বসে আড্ডা এবং ভবঘুরে চলাফেরাসহ অভিভাবকদের শাসন না থাকায় এ অকৃতকার্যের কারন।
বিন্নাবাইদ এলাকার সুশিল সমাজের প্রতিনিধি মোঃ রুবেল পারভেজ মনে করেন,বিদ্যালয়ের শিক্ষক,ম্যানেজিং কমিটির দোষের পাশাপাশি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরাও পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হবার জন্য দায়ী। তাছাড়া বর্তমানে প্রতিটি ঘরেই প্রবেশ করেছে অবাধ্যতা,স্মার্টফোন আসক্তি ও অনলাইন অফলাইন জুয়া। পড়ালেখা ছেড়ে শিক্ষার্থীরা এসব কু- অভ্যাসে আসক্ত হয়ে পড়ায় অকৃতকার্য হবার কারন।
সররাবাদ ধনু মাষ্টার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু হানিফের মোবাইলে একাধিকবার ফোন দিয়ে সাংবাদিক পরিচয় দেয়ার পরই উনি মোবাইল বন্ধ করে দেন। উত্তেজিত জনতা কর্তৃক এই স্কুলে তালা ঝুলানোর পর উনি সহ বিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষকদেরও মোবাইল বন্ধ থাকায় বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
অত্র বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সদস্য শফিকুল ইসলাম শফু বলেন,স্কুলের প্রধান শিক্ষক তার মনগড়া মতো স্কুল পরিচালনা করেন। স্কুলের রেজাল্ট খারাপ হবার জন্য তিনিই দায়ী। বিদ্যালয়ের বই বিক্রির টাকা তিনি আত্মসাৎ করেছেন। তাছাড়া শিক্ষকরা সময় মতো বিদ্যালয়ে আসেন না। এই প্রধান শিক্ষকের অবসারণ চাই।
বিদ্যালয়টি ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ফিরোজা হক পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হবার কথা স্বীকার করে বলেন,শিক্ষকদের অবহেলার কারনেই এমনটা হয়েছে। আমি আগামীকাল বিদ্যালয়ে যাব।
বেলাব সরকারী পাইলট মর্ডান উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রবীর কুমার ঘোষ বলেন,শুধু বেলাবতেই নয় সারা দেশেই মানবিক বিভাগে অকৃতকার্যের সংখ্যা বেশি। আসলে মানবিকে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী হয় ছেলে। ছেলেরা লেখাপড়া কম করে। তাদের মধ্যে মোবাইলে আসক্তির পরিমাণ বেশি। একারনে ফল বিপর্যয় হয়েছে।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার শেখ মতিউর রহমান বলেন,শিক্ষার্থীরা অতিরিক্ত মোবাইলে আসক্তি ও পড়ার টেবিলে না বসায় রেজাল্ট খারাপ করেছে। তবে কিছু কিছু বিদ্যালয়ে শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির দ্বন্ধের কারনও দায়ী।
বেলাব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আয়শা জান্নাত তাহেরা এসএসসি পরীক্ষায় ফলাফল খারাপ হবার জন্য শিক্ষকদের পাঠদানে গাফিলতির কথা ও অভিভাবকদের দায়িত্বে অবহেলার কথা স্বীকার করে বলেন,সররাবাদ ধনু মাষ্টার উচ্চ বিদ্যালয়ের কেউ আমাকে এখন পর্যন্ত অবগত করেনি। অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিব।
Leave a Reply