শেখ আব্দুল জলিল
হুমিখে নিজস্ব কোন জায়গা নেইকে। হুমিখে সরকারী জায়গামে রতানিজা। ছেখ হাছিনা হামিকে ঘর বানাতেদিতীয়া,জায়গা দেতিয়া,ভগমান তাকে বাঁচাকে রাখুক। গরীব অবদিকে দেখতিয়া ভগমান ওকারেখে যুগ যুগ বাচাইয়া রাখুক।
হরিজন সম্প্রদায়ের নিজস্ব ভাষায় কথাগুলো বলতে বলতে আনন্দে কেঁদে ফেললেন হরিজন গৃহবধু লক্ষ্মীরাণী।
লক্ষ্মীরাণীর চোখে আনন্দের অশ্রু।
নিজের জায়গা বলতে কিছুই নেই। স্বামী কাজ করে বাজার পরিস্কারের। নিজে গৃহিনী। চারজনের সংসারে এভাবে চলে দিনের পর দিন। ময়লা আবর্জনা নোংরা পরিবেশের সাথে বড় হওয়া লক্ষ্মীরাণী স্বপ্নেও ভাবেনি সরকার তাদের নিজস্ব জায়গা দিবে নিজস্ব ঘর দিবে। শুধু লক্ষ্মীরাণী নয় বেলাব উপজেলার বেলাব নামাবাজারে দীর্ঘদিন ধরে সরকারী জায়গায় অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে গাদাগাদি করে বসবাস করা ৩০টি হরিজন পরিবার এখন সরকারী জায়গার পরিবর্তে মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে আশ্রয়ন প্রকল্প-২ এর আওতায় জায়গাসহ ঘরে উঠার অপেক্ষায়।
জানা যায়,পাকিস্তান আমল থেকে অস্থায়ী ভাবে সরকারী জায়গায় বেলাব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কাছাকাছি স্থানে হরিজন সম্প্রদায়ের কয়েকটি পরিবার বসবাস ছিল। দেশ স্বাধীনের কিছুদিন পর তাদেরকে আবার স্থানান্তরীত করা হয় বেলাব নামা বাজারে মুক্তিযুদ্ধা কমপ্লেক্সের নিকটবর্তী স্থানে।
এ সম্প্রদায়ের বেশির ভাগ পুরুষ সদস্য বাজার পরিস্কার করা,মেথরের কাজ করা ও জুতা সেলাই করে জীবিকা নির্বাহ করে।
মহিলারাও পরিবারের পুরুষ সদস্যের পাশাপাশি বাজার পরিস্কারসহ অন্যান্য কাজ করে জীবিবা নির্বাহ করে। তাদের নিজস্ব কোন জায়গা,ঘর নেই। নেই নিজস্ব কোন ঠিকানা।
অবহেলিত এই সম্প্রদায়টি যুগযুগ ধরে যাযাবরের মত বেলাব বাজারের বিভিন্ন স্থানে অস্থায়ী খোঁপড়ি ঘর বেঁধে বসবাস করে আসছে।
বর্তমানে প্রায় ৪০ বছর যাবৎ বেলাব নামা বাজারে আড়িয়াল খাঁ নদের তীরে মুক্তিযুদ্ধা কমপ্লেক্সের সন্নিকটে মুচি পাঁড়ায় তাদের বাস।
সরেজমিনে বেলাব নামা বাজারে মুচি পল্লিতে গিয়ে দেখা যায়,অবহেলিত এ সম্প্রদায়ের প্রায় ৩০ টি পরিবারের প্রায় দুইশ থেকে আড়াইশ সদস্যেরা খুবই কষ্টে দিনযাপন করছে।
এখানে হরিজন,রবিদাস,হিন্দু,মুসলমানসহ বিভিন্ন গোত্রের নিম্ন পেশার দুই শতাধিক মানুষের মানবেতর জীবন চিত্র হার মানাবে পৃথিবীর যেকোন পেশার মানুষকেও।
ভাঙ্গা খুঁপড়ি ঘর,স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার অভাব,বিশুদ্ধ পানির অভাব এ সম্প্রদায়ে বহুদিন ধরে।
আনুমানিক আধা বিঘা জমির উপর ঠাসাঠাসি করে ছোট ছোট ঘর তৈরী করে বসবাস করে ৩০ পরিবারের প্রায় দুই থেকে আড়াইশ সদস্য।
জায়গার অভাবে গরু ছাগল ভেড়াসহ অন্যান্য গৃহপালিত পশু আর মানুষের এখানে একসাথে বাস।
শিশুদের নেই কোন খেলার মাঠ। নেই লেখাপড়ার পরিবেশও। এর কয়েকগজ দূরেই আড়িয়াল খাঁ নদের তীরে তাদের ঘর তৈরীর কাজ চলছে পুরাধমে। যেখানে হরিজন সম্প্রদায়ের জন্য আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘর নির্মান করা হবে এর পাশেই তৈরী হয়েছে মুক্তিযুদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন। তৈরী হবে শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম,উপজেলা শিল্পকলা একাডেমি।
জানা গেছে হরিজন সম্প্রদায়ের বিষয়টি প্রথমে নজরে আসে বেলাব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আক্তার হোসেন শাহিনের। তারপর থেকে এ সম্প্রদায়ের জন্য নিজস্ব জমি ও নিজস্ব ঘর দেয়ার জন্য তিনি চেষ্ঠা করতে থাকেন। একসময় সফল হোন। এখন বাস্তবায়নের পালা।
তিনি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়,মুজিব বর্ষ উপলক্ষে এবার সরকারের বিশেষ অগ্রাধিকার আশ্রয়ন প্রকল্পের আওতায় আনা হচ্ছে বেলাবরের হরিজন সম্প্রদায়ের ৩০টি পরিবার। প্রতিটি পরিবারকে দেয়া হবে একটি করে দুই কক্ষ বিশিষ্ট সেমিপাকা ঘর দুই শতক জমির মালিকানা দলিল। এছাড়াও স্বাস্থ্য সম্মত পায়খানা খোলা জায়গা,বিশুদ্ধ পানি ও বিদ্যুৎতের ব্যবস্থাও দেয়া হবে তাদের।
উপজেলা ভূমি কার্যালয় জানান,ইতিমধ্যে পরিত্যক্ত ৬৫ শতাংশ জমি নেয়া হচ্ছে হরিজন সম্প্রদায়ের জন্য। মাটি ভরাট হয়েছে ৭০ শতাংশ জমিতে। ইট সিমেন্ট বালু সব ক্রয় করা হয়েছে। যেহেতু নদীর তীরে আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘর হচ্ছে সেহেতু ভাঙ্গন রোধে পেলা সাইডিং সিষ্টেম রেখেই কাজ করা হয়েছে। দুই থেকে আড়াই মাসের মধ্যে হরিজন সম্প্রদায়কে ঘর উপহার দেয়া যাবে আাশা করছি।
হরিজন সম্প্রদায়ের কার্তিক বাবু জানান,আমাদের ছরকার ঘর দিবে শুনেছি। জায়গাও দিবে। কিন্তু আমরা আমাদের বাপ দাদার পেশা ছাড়তে চাই। জুতা সেলাই,মিথরের কাজ ভাল লাগেনা। ছরকারের কাছে দাবী আমাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ভাল কাজের ব্যবস্থা করে দিক।
গৃহিনী গীতা রাণী বলেন,আমার স্বামী জুতা সেলাই করে। আমি বাজার পরিস্কার করি। সরকার আমাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ঋণ দিয়ে স্বাবলম্বি করুক। এটাই আমাদের দাবি।
বেলাব সদর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী সাফি বলেন,এ সম্প্রদায়টি অত্যান্ত অবহেলিত। তাদের কোন জায়গা জমি নেই। তাদের জন্য সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে সেটা প্রশংসনীয়।
বেলাব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আক্তার হোসেন শাহিন জানান,হরিজন পল্লীর পাশেই মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন। সেখানে মুক্তিযোদ্ধারা যেতে চায়না। কারণ হরিজন সম্প্রদায়ের অপরিস্কার অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের কারনে। একারনে প্রথমে আমি আমার উধ্বতন ও মাননীয় শিল্পমন্ত্রী মহোদয়ের সাথে আলোচনা করে তাদের জন্য আলাদাভাবে পরিত্যক্ত জায়গায় মাটি ভরাট করে আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘর নির্মানের আবেদন করি। আবেদন অনুযায়ী প্রতিটি ঘরের জন্য দুই লক্ষ উনষাট হাজার পাঁচশ টাকা করে ৩০ টি ঘরের জন্য ৭৭ লক্ষ ৮৫ হাজার টাকা বরাদ্ধ পাই। আশা করছি দুই থেকে আড়াই মাসের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারবো।
Leave a Reply