আজ ২৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১২ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

অমুক্তিযোদ্ধার সম্মানী ভাতা-ঋণের টাকা নিয়ে জেলা জুড়ে নানা গুঞ্জন!

আশরাফুল হক, লালমনিরহাটঃ

দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) এর তদন্ত প্রতিবেদনে লালমনিরহাট সদর উপজেলার হারাটি ইউনিয়নের কাজীর চওড়া গ্রামের মৃত তারিণী চন্দ্রের ছেলে প্রতাপ চন্দ্র রায় একজন অমুক্তিযোদ্ধা। সেই অমুক্তিযোদ্ধাকে হঠাৎ করে সম্মানী ভাতা ও গৃহঋণের ৮ লক্ষ টাকা প্রদানের ঘটনায় নানান গুঞ্জন সৃষ্টি হয়েছে।

দফায় দফায় তদন্ত কমিটির কাছে প্রতাপ চন্দ্র রায় অমুক্তিযোদ্ধা প্রমাণ থাকলেও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহমুদা মাসুম ও সাধারণ সম্পাদক সোনালী ব্যাংক লিঃ, লালমনিরহাট শাখার সিনিয়র পিন্সিপাল অফিসার আব্দুল মতিন সরকারের সহযোগীতায় এক অমুক্তিযোদ্ধার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

জানা গেছে, ২০১৯ সালের (২ জুলাই) রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সম্মানী ভাতা পেতে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) লালমনিরহাট জেলা পরিষদ মিলনায়তনে দুদকের গণশুনানিতে নিজেকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা দাবী করেন প্রতাপ চন্দ্র রায়। জেলা প্রশাসক আবু জাফরের সভাপতিত্বে গণশুনানি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, দুদক পরিচালক নাসিম আনোয়ার, মনিরুজ্জামান খান।
অবশেষে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) গণশুনানীতে লিখিত আবেদন করেন প্রতাপ চন্দ্র রায়। এরেই প্রেক্ষিতে
পরবর্তীতে রংপুরের দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক শেখ মেসবাহ উদ্দিন স্বাক্ষরিত পত্রের স্মারক নং-০৪.০১.৮৫০০.৭২৫.৯৯. ০২৪.১৯.১১৬৫, ২০/০৮/২০১৯ইং তারিখে লালমনিরহাট সদর উপজেলায় অনুষ্ঠিত গণশুনানিতে প্রাপ্ত অভিযোগ সিদ্ধান্ত মোতাবেক গৃহীত ব্যবস্থাদির উপর প্রতিবেদন প্রেরণের জন্য সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার-কে নির্দেশ দেন। উক্ত গণশুনানিতে প্রাপ্ত অভিযোগের ২নং তালিকায় প্রতাপ চন্দ্র রায়ের নাম রয়েছে। তার অভিযোগ, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার ভাতা অন্য আরেক জনের উত্তোলন করছেন। অভিযোগটি “লালমনিরহাট
সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার, দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও সমাজসেবা অফিসার”
একত্রে তদন্ত করে ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেয় দুদক। যার ৪১.০১.৫২৫৫. ০০০. ১৬.২৭২.১৭.৬৬৬, ২৬/০৯/২০১৯ইং তারিখ স্মারকে শুনানিতে প্রাপ্ত অভিযোগ প্রতাপ চন্দ্র রায়ের
প্রতিবেদন জমা দেন। উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, সদর উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা বাস্তবায়ন
কমিটিতে যাচাই-বাছাই করা হয়। প্রথম বার সভায় প্রতাপ চন্দ্র রায় তার প্রমাণ ছাড়াই উপস্থিত হয়ে শুধুমাত্র
যুদ্ধকালীন তার অবস্থান, তিনি কোথায় যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এসব বিষয়ে বক্তব্য দেন। পরবর্তীতে নির্ধারিত
তারিখে সকল প্রমাণসহ ২জন সহযোদ্ধা নিয়ে উপস্থিত হতে প্রতাপ চন্দ্র রায়কে বলেন তদন্ত কমিটি। সেই তারিখে ২ জনের মধ্যে ১ জন সহযোদ্ধাকে নিয়ে তদন্ত কমিটির সামনে হাজির হয়ে নতুন করে তার যুদ্ধকালীন অবস্থান সম্পর্কে কমিটিকে অবগত করেন যা পূর্বের যুদ্ধকালীন বর্ণনার সাথে কোন মিল পাননি। ওই সময় প্রতাপ চন্দ্র রায়ের সহযোদ্ধা তদন্ত কমিটিকে জানান, তিনি প্রতাপ চন্দ্রকে ওকড়াবাড়ি শরনার্থী ক্যাম্পে দেখেছিলেন।

সেখানে তিনি প্রতাপ চন্দ্রকে রেখে প্রশিক্ষণ নিতে চলে যান। তিনি প্রতাপ চন্দ্রের সাথে প্রশিক্ষণ বা যুদ্ধে অংশ
গ্রহন করেননি। এমতাবস্থায় প্রতাপ চন্দ্র রায় আরও ২ জন সহযোদ্ধার সাক্ষ্য নেয়ার আবেদন করলে তদন্ত কমিটি তাকে পুনরায় সুযোগ দেন। নির্ধারিত তারিখে প্রতাপ চন্দ্রের ২ জন সহযোদ্ধার উপস্থিত হয়ে একজন সহযোদ্ধা তাকে ওকড়াবাড়িতে ও আর একজন সহযোদ্ধা তাকে বাউড়াতে দেখেছেন। কিন্তু তাদের কারও সাথেই

প্রতাপ চন্দ্র রায় প্রশিক্ষণ কিংবা যুদ্ধে অংশ গ্রহন করেননি। সকল সাক্ষ্য প্রমাণ গ্রহন শেষে তদন্ত কমিটির নিকট প্রতীয়মান হয় যে, প্রতাপ চন্দ্র সঠিক ব্যক্তি নয়। পরবর্তীতে ২০২১ইং সালে লালমনিরহাটের বীর মুক্তিযোদ্ধের সম্মাণী ভাতা বিতরণের দায়িত্ব উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের পরিবর্তে সোনালী ব্যাংক, লালমনিরহাট শাখায় হস্তান্তর করা হয়। যা পদাধিকার বলে, সদর উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও সাধারণ সম্পাদক, সোনালী ব্যাংক, লালমনিরহাট শাখা ব্যবস্থাপক। একজন অমুক্তিযোদ্ধা প্রতাপ চন্দ্র রায়কে শুধু ভাতা প্রদান করে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সম্মানি ভাতা বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি উপজেলা
নির্বাহী অফিসার মাহ্মুদা মাসুম ও সাধারণ সম্পাদক, সোনালী ব্যাংক লিঃ, লালমনিরহাট শাখার সিনিয়র
পিন্সিপাল অফিসার আব্দুল মতিন সরকার ক্ষান্ত হয়নি। চলতি বছরের আগষ্ট মাসে সোনালী ব্যাংক লিঃ, লালমনিরহাট শাখার মাধ্যমে ৮ লক্ষ টাকা গৃহঋণ দেয়া হয়েছে। ফলে জেলা ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে নানান গুঞ্জন সৃষ্টি হয়।

এমনকি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের চাপের মুখে অবশেষে প্রতাপ চন্দ্র রায়ের সম্মানী ভাতা সাময়িক ভাবে স্থগিত করেন।
এবং গৃহ ঋণের ৮ লক্ষ টাকা দফায় দফায় আদায় শুরু করেছেন সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে প্রতাপ চন্দ্র রায় বলেন, চলতি বছরে আমার নামে সম্মানী ভাতা চালু হয়েছে। আমি ইতিমধ্যে সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে ৬ মাসের সম্মানী ভাতা হিসেবে ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা পেয়েছি। তারপর আরও ১ মাসের সম্মানী ভাতা হিসেবে ২০ হাজার টাকা পেয়েছি। এর মাঝে গৃহঋণ বাবদ পেয়েছি ৮ লক্ষ টাকা পেয়েছি। কিন্তু আগষ্ট মাসে হঠাৎ করে আমার সম্মানী ভাতা সাময়িক ভাবে স্থগিত করে গৃহঋণের ৮ লক্ষ টাকা ফিরত দেয়ার চাপ দেন সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সম্মানি ভাতা বাস্তবায়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক, সোনালী ব্যাংক লিঃ,
লালমনিরহাট শাখার সিনিয়র পিন্সিপাল অফিসার আব্দুল মতিন সরকার বলেন, আমরা নতুন ভাবে দায়িত্ব পেয়েছি। তাই তার ব্যাপারে বেশি কিছু জানা ছিল না। সম্মানী ভাতা ও ঋণ প্রদানের পরে প্রতাপ চন্দ্রের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ উঠেছে। তাই আপাতত সম্মানী ভাতা সাময়িক ভাবে স্থগিত করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহমুদা মাসুম বলেন, প্রতাপ চন্দ্র রায় ভাতা পাওয়ার পরে অমুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নানান কথা শুনা যাচ্ছে।
প্রতাপ চন্দ্র রায় মুক্তিযোদ্ধা না অমুক্তিযোদ্ধা তা পুনবায় যাচাই-বাছাইয়ের জন্য মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়
সহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরে পত্র পাঠানো হয়েছে।

এ ক্যাটাগরির আরো নিউজ...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এ ক্যাটাগরির আরো নিউজ...